সাংবাদিকদের স্থায়ী চাকরির শুরুর বেতন নির্ধারণে একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব এনেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। কমিশনের মতে, সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন সরকারি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মূল বেতনের সমান হওয়া উচিত। এই প্রস্তাবটি সারা দেশের সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা
গত শনিবার (২২ মার্চ) গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা, চাকরির স্থায়িত্ব, এবং শ্রম আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। কমিশনের মতে, বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় বেতন ও চাকরির অনিশ্চয়তা বাড়ছে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য হুমকিস্বরূপ।
সাংবাদিকতা পেশার চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষিত বেকারত্বও বাড়ছে। এর ফলে সাংবাদিকতা পেশায় বেতন কমে যাচ্ছে এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে চাকরির স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। এ অবস্থায় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।
গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য সুপারিশসমূহ
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সাংবাদিকদের আর্থিক ও পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো উপস্থাপন করেছে:
১. ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ: সাংবাদিকদের স্থায়ী চাকরির শুরুর বেতন সরকারি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মূল বেতনের সমান হবে। ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য ‘ঢাকা ভাতা’ প্রদান করা হবে।
২. বেতন কাঠামো: মূল বেতনের পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা, উৎসব ভাতা, ঝুঁকি ভাতা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও অবসর ভাতা প্রদান করা হবে।
৩. মূল্যস্ফীতি সমন্বয়: প্রতিবছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন ও অন্যান্য ভাতা সমন্বয় করা হবে।
৪. শিক্ষানবিশ সাংবাদিকদের ভাতা: শিক্ষানবিশ সাংবাদিকদের চাকরির মেয়াদ এক বছরের বেশি হবে না এবং তাদের জন্য সম্মানজনক শিক্ষানবিশ ভাতা নির্ধারণ করতে হবে।
৫. ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের জন্য নীতিমালা: ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের জন্য পৃথক নিয়োগ নীতিমালা ও ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করতে হবে।
৬. সার্কুলেশন বা বিজ্ঞাপন সংগ্রহ নিষেধ: কোনো সাংবাদিককে সার্কুলেশন বা বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা যাবে না।
৭. আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন: নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশনস অব সার্ভিসেস) অ্যাক্ট ১৯৭৩ ও শ্রম আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. সরঞ্জাম সরবরাহ: গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আলোকচিত্রী ও ভিডিও সাংবাদিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করবে।
৯. নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ: সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং পেশাগত কারণে কোনো মামলার ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা দিতে হবে।
১০. অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি: গণমাধ্যমের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সাংবাদিকদের বেতন বৃদ্ধির অনুপাতে বৃদ্ধি করতে হবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের গঠন
গত ১৮ নভেম্বর সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন ১১ সদস্যের গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেয়। কমিশনের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদ। কমিশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, এবং কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
আশাবাদ
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে করে সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব আরও স্বাধীনভাবে ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে সক্ষম হবেন, যা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য।
এই প্রস্তাবনা সাংবাদিকতা পেশার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করবে এবং গণমাধ্যমের টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।