একটি ছোট্ট মেয়ের মায়ের জন্য কান্না দেখে সন্দেহে ফুঁসে উঠল স্থানীয় জনতা। কেউ জিজ্ঞাসা করল না, কেউ প্রমাণ চাইল না—শুধু ধরে বেঁধে পিটিয়ে দিল এক অসহায় বাবাকে। শিশুটির চিৎকার, “আব্বা! আব্বা!” কেউ শুনল না। ঘটনাটি ঘটেছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলায়। এটি শুধু একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, এটি আমাদের সমাজের অসচেতনতা ও সহিংসতার চিত্রও ফুটে তুলেছে।
কী ঘটেছিল?
সোহেল মিয়া (৩০) কিশোরগঞ্জ পৌর শহরের বাসিন্দা। প্রায় ১০ বছর আগে সাবিনা আক্তার (২৫) এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাদের তিন সন্তান রয়েছে। কিছুদিন আগে বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানরা সোহেলের কাছে থাকে। তিন বছর বয়সী রাইসা মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। মেয়ের কান্না দেখে সোহেল সাবিনার খোঁজে বের হন।
গত রোববার বিকেলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে রাইসাকে নিয়ে কুলিয়ারচরের আগরপুর বাসস্ট্যান্ড অতিক্রম করার সময় মেয়েটি মায়ের জন্য জোরে কান্না শুরু করে। শিশুটির কান্না দেখে পথচারীদের সন্দেহ হয়। কেউ কেউ ভাবে, সোহেল নিশ্চয়ই শিশুটি অপহরণ করেছে। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই জনতা সোহেলকে ঘিরে ধরে, বেঁধে ফেলে এবং নির্মমভাবে পিটাতে শুরু করে।
“আব্বা! আব্বা!” চিৎকারেও রক্ষা পেলেন না বাবা
রাইসা চিৎকার করে বলছিল, “আব্বা! আব্বা!” কিন্তু উত্তেজিত জনতা তা পাত্তা দেয়নি। সোহেল বারবার চেষ্টা করেছিলেন বোঝানোর—”এই ভাই, আমার কথা শুনুন!” কিন্তু কেউ শুনতে চায়নি। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে প্রমাণিত হয়, সোহেল আসলেই রাইসার বাবা, কোনো অপহরণকারী নন।
পরিবারের করুণ অবস্থা
সোহেলকে উদ্ধারের পর পরিবারের সদস্যরা থানায় আসেন। তাঁর মা নিয়া শাহ বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, “আমার নাতি আব্বা আব্বা করে কাঁদছিল, তবুও কেউ থামল না! মানুষের বুদ্ধি কী এতটাই লোপ পেয়েছে?”
সোহেলকে প্রথমে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর শরীরে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
জনতার স্বীকারোক্তি: “আমরা ভুল করেছি”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি পরে স্বীকার করেন যে তারা ভুল করেছিলেন। একজন বলেন, “শিশুটি কাঁদছিল, আর সোহেল মিয়ার চেহারা আমাদের কাছে সন্দেহজনক লাগছিল। কিন্তু যখন সে ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছিল, তখন আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।”
অন্য একজন যোগ করেন, “কিছু মানুষ ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিল, কেউ আসল ঘটনা জানার চেষ্টা করেনি। সামাজিক মাধ্যমেই ঘটনাটি ‘শিশু অপহরণকারী ধরা’ শিরোনামে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে।”
পুলিশের বক্তব্য
কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু প্রমাণ ছাড়াই কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।”
সামাজিক সচেতনতা জরুরি
এই ঘটনা আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন রেখে যায়—আমরা কতটা সচেতন? একটি শিশুর কান্না দেখেই কি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব যে সে অপহৃত হচ্ছে? সামাজিক মাধ্যমের ভাইরাল হওয়ার লোভে কি আমরা ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে ভুলে যাচ্ছি?
শিক্ষণীয় বিষয়:
১. প্রমাণ ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক – কোনো ঘটনায় জড়িত হওয়ার আগে সত্যতা যাচাই করুন।
২. শিশুর কান্নার কারণ বুঝুন – সব কান্নাই অপহরণের লক্ষণ নয়।
৩. সামাজিক দায়িত্ব – ভিডিও করে ভাইরাল করার আগে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করুন।
উপসংহার
সোহেল মিয়ার ঘটনা আমাদের সমাজের অন্ধকার দিকটি উন্মোচন করেছে। একটি শিশুর কান্না, একটি বাবার আর্তনাদ—কেউ শুনল না। আমরা যদি সামান্য সচেতন হই, একটু যাচাই-বাছাই করি, তাহলে হয়তো এমন নির্মম ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
আরও পড়ুন: সোনারগাঁয়ে নবদম্পতির ওপর নির্মম নির্যাতন: স্বামীর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি
আপনার কী মনে হয়? এমন ঘটনা রোধ করতে আমরা কী করতে পারি? কমেন্টে আপনার মতামত জানান।