দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের দীর্ঘতম রেলসেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকালে সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে উদ্বোধনী ট্রেনটি মাত্র তিন মিনিটে যমুনা নদী পার হয়ে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে পৌঁছায়। এই সেতু চালুর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রেল যোগাযোগের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনইচি এবং জাইকার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক ইতো তেরুয়ুকি অংশ নেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান। সমাপনী বক্তব্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন সেতুটির গুরুত্ব ও সম্ভাবনার দিকগুলো তুলে ধরেন।
দুপুর ১২টা ৬ মিনিটে ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশন থেকে উদ্বোধনী ট্রেন যাত্রা শুরু করে। মাত্র ৯ মিনিটের মধ্যে ট্রেনটি যমুনা নদী পার হয়ে সয়দাবাদ স্টেশনে পৌঁছায়। এই সময়ের মধ্যে সেতুটি পার হতে সময় লেগেছে মাত্র তিন মিনিট। আগে যমুনা সড়কসেতু দিয়ে ট্রেন পার হতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগত। নতুন সেতু চালুর ফলে যাত্রীদের সময় ও সুবিধা দুটিই বেড়েছে।
সেতুর বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব
যমুনা রেলসেতুটি দেশের রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার এবং এটি ৫০টি পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যানে নির্মিত। সেতুতে দুটি লাইন (ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাক) রয়েছে, যা দিয়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। তবে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
এই সেতু চালুর ফলে পুরোনো যমুনা সড়কসেতুর রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন সেতুটি নির্মাণের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি রেল যোগাযোগ আরও দ্রুত ও নিরাপদ হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সেতুটি চালুর পর প্রতিদিন গড়ে ৫০টি ট্রেন চলাচল করবে, যা আগামী দিনে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রকল্পের ইতিহাস ও চ্যালেঞ্জ
যমুনা রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা এবং কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০২৩ সাল। তবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও ব্যয়বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সাল নির্ধারণ করা হয়। সর্বশেষ হিসাবে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
প্রকল্পের শুরুতে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেতুটির নাম পরিবর্তন করে যমুনা রেলসেতু রাখা হয়।
জনগণের প্রতিক্রিয়া
যমুনা রেলসেতু চালুর খবরে এলাকাবাসী ও যাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে। সেতুটি চালুর ফলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সহজ ও দ্রুততর হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আশা, এই সেতুটি শুধু যাত্রী পরিবহনই নয়, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী দিনে এই সেতু দিয়ে আরও বেশি সংখ্যক ট্রেন চলাচল করবে। এছাড়া, সেতুটির মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যমুনা রেলসেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এটি শুধু একটি সেতুই নয়, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হবে।
আরও পড়ুন: লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের প্রধান ঢাকায় বিমানবন্দরে আটক