বাংলাদেশে পুরুষদের ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। আইনের আশ্রয় নেওয়ার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের আগ্রহ কম, কারণ দেশের বিদ্যমান আইনে পুরুষদের ধর্ষণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। ফলে, এ ধরনের ঘটনায় বিচার চাইতে হলে ভিন্ন আইনের সহায়তা নিতে হয়।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে এক তরুণের ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ২০ বছর বয়সী এই তরুণের বিরুদ্ধে ঘটনার তিন দিন পর মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম জানান, অভিযোগ অনুযায়ী, ভুক্তভোগীর এক প্রতিবেশী তাকে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক করে। এই মামলাটি ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় ‘বলাৎকার’ হিসেবে রুজু করা হয়েছে। কারণ, ১৬ বছরের বেশি বয়সী ছেলেদের ধর্ষণের জন্য বাংলাদেশে আলাদা কোনো আইন নেই।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সী ১১১ জন ছেলে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কিন্তু মামলা করা হয়েছে মাত্র ৫৫টি। বিশ্লেষকদের মতে, পুরুষ নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে ভুক্তভোগীরা যথাযথ বিচার পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হলেও, পুরুষদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার তুলনায় পুরুষদের যৌন নির্যাতনের তথ্য খুব কমই প্রকাশিত হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ২২৬ জন পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে মামলা করা হয়েছে ১৪৬টি। এছাড়া, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৪ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে, এবং এসময়ে মামলা হয়েছে ১৪টি। ২০২৩ সালে ৭৫ জন এবং ২০২৪ সালে ৩৬ জন ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র একজন নারীই ধর্ষণের শিকার হতে পারেন, এবং অপরাধী হতে হবে একজন পুরুষ। অর্থাৎ, কোনো পুরুষ যদি ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে তার জন্য আইনে কোনো বিধান নেই। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “ছেলেদের ধর্ষণের বিষয়টি আইনে কখনো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।”
২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে মূলত নারী ও ১৬ বছরের কম বয়সী মেয়ে শিশুদের কথা বলা হলেও, পরবর্তীতে হাইকোর্টের আদেশে ছেলে শিশুদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে, ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনো ছেলে ধর্ষণের শিকার হলে, এই আইনে তার জন্য কোনো বিধান নেই। ফলে, এ ধরনের ঘটনায় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী মামলা করতে হয়, যা প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
আইনজীবী তারিক রিজভী বলেন, “পেনাল কোডের আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ধর্ষণ হয় না, এটাই প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয়ত, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের জন্য কোনো ধারা নেই। ফলে, এই আইন অনুযায়ীও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়।”
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জহিরুল ইসলাম খান পান্না মনে করেন, ধর্ষণের অভিযোগে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বিভেদ হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, “ছেলেদের সাথেও জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক ঘটানো হচ্ছে। ফলে, এক্ষেত্রে সমান শাস্তিই হওয়া উচিত।”
আইনজীবী ইশরাত হাসান আরও যোগ করেন, “তৃতীয় লিঙ্গের কেউ ধর্ষণের শিকার হলে, তার জন্যও আলাদা কোনো আইন নেই। কিন্তু তাদেরও বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।”
বর্তমানে ছেলেরা ধর্ষণের শিকার হলে ৩৭৭ ধারায় মামলা করা হলেও, সংশ্লিষ্টরা মনে করেন যে এই বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ইশরাত হাসান বলেন, “আইনের যৌক্তিক সংস্কার প্রয়োজন। আগে পেনাল কোডের মাধ্যমেই ধর্ষণের সাজা হতো। পরে বিশেষ আইন হিসেবে নারী নির্যাতন দমন আইন আসলো। কিন্তু এখনও অনেক বিষয়ই আগের আইনে বিচার হয়ে আসছে, এতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা করলে মেডিক্যাল টেস্ট, ডিএনএ টেস্টের বিধান আছে। কিন্তু পেনাল কোডে এই বিধানগুলো নেই। ফলে, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ধর্ষণের দ্রুত বিচার পেতে ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, “ল্যাব থেকে রিপোর্ট পেতে চার-পাঁচ মাস লেগে যায়। আইনে ৯০ দিনে বিচারের কথা থাকলেও, রিপোর্ট পাওয়ার আগে বিচারক কীভাবে বিচার করবেন?”
তিনি আরও পরামর্শ দেন, প্রত্যেক বিভাগে মেডিক্যাল টেস্ট ও ডিএনএ টেস্টের ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন। সবমিলিয়ে, পরিকল্পনা, কৌশল ও আইনের ফাঁকগুলো চিহ্নিত করে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের দিকে জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন: টাকার লোভ দেখিয়ে শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবক গ্রেপ্তার