ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন আমরা ধর্ষণের কথা বলি, সাধারণত নারী বা শিশুদের কথাই চিন্তা করি। অথচ পুরুষরাও ধর্ষণের শিকার হয়, এবং বাংলাদেশের আইনে এই বিষয়টি প্রায় সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জে একজন তরুণের ধর্ষণের ঘটনা আলোচনায় এসেছে, যা পুরুষ ধর্ষণের আইনি শূন্যতার দিকে আবারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
পুরুষ ধর্ষণ: একটি অদৃশ্য সমস্যা
বাংলাদেশে পুরুষ ধর্ষণের ঘটনাগুলো প্রায়ই গোপন থাকে। সামাজিক লজ্জা, ভুক্তভোগীর প্রতি অবিশ্বাস এবং আইনি সুরক্ষার অভাবের কারণে অনেকেই এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ করতে চান না। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা নেহাতই কম নয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ২২৬ জন ছেলে শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
২০২৩ সালে ৭৫ জন এবং ২০২৪ সালের প্রথম কয়েক মাসেই ৩৬ জন ছেলে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে রেকর্ড করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতিও ভিন্ন নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ জন ধর্ষণ ভুক্তভোগীর মধ্যে ১ জন পুরুষ (RAINN-এর তথ্য)।
তবুও বাংলাদেশের আইনে পুরুষ ধর্ষণকে স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের আইনে পুরুষ ধর্ষণের অবস্থান
বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত, যেখানে শুধুমাত্র নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারে। অর্থাৎ, কোনো পুরুষ ধর্ষণের শিকার হলে তাকে আইনি সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আলাদা কোনো ধারা নেই।
পুরুষ ধর্ষণের ক্ষেত্রে কী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়?
১. ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা (অপ্রাকৃতিক অপরাধ):
এই ধারা অনুযায়ী, “প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার” (সডোমি) একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় এই ধারায় মামলা করা হয়েছে।
সমস্যা হলো, এটি সরাসরি ধর্ষণের সংজ্ঞায় পড়ে না এবং শাস্তির মাত্রাও ভিন্ন।
২. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০):
এই আইনে মূলত নারী ও ১৬ বছরের কম বয়সী ছেলে শিশুদের জন্য বিধান আছে।
১৬ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ ধর্ষণের শিকার হলে এই আইন প্রযোজ্য নয়।
৩. শারীরিক নির্যাতনের জন্য সাধারণ আইন:
ধর্ষণের শিকার পুরুষরা আঘাত, জোরপূর্বক আটকে রাখা বা মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করতে পারেন।
তবে এটি সরাসরি যৌন সহিংসতাকে কভার করে না।
আইনি ফাঁক ও এর পরিণতি
অপরাধী শাস্তি এড়াতে পারে: যেহেতু ধর্ষণের সংজ্ঞায় পুরুষ অন্তর্ভুক্ত নয়, অনেক অপরাধী আইনের ফাঁক ব্যবহার করে পার পেয়ে যায়।
ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়া কঠিন: ৩৭৭ ধারায় মামলা করলে সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করা জটিল, এবং মামলা দীর্ঘায়িত হয়।
সামাজিক কুসংস্কার: পুরুষ ধর্ষণকে অনেকেই “হাস্যকর” বা “অসম্ভব” মনে করেন, যা ভুক্তভোগীদের আরও নিঃসহায় করে তোলে।
আইন সংস্কারের দাবি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের আইনে জেন্ডার-নিরপেক্ষ ধর্ষণের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়াও:
✔ ধর্ষণের সংজ্ঞায় পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করা।
✔ দ্রুত বিচার ও ফরেনসিক পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানো।
✔ পুরুষ ধর্ষণ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা।
উপসংহার
পুরুষ ধর্ষণ একটি বাস্তব সমস্যা, যা আইনের অভাবে প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। নারী ও শিশুদের পাশাপাশি পুরুষদেরও যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইনি সংস্কার ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে এই অদৃশ্য সংকটের সমাধান করতে।
আরও পড়ুন: ধর্ষণ: একটি সামাজিক অভিশাপ ও ইসলামের কঠোর অবস্থান
আপনার কী মতামত? পুরুষ ধর্ষণ নিয়ে আইনি পরিবর্তন প্রয়োজন বলে কি আপনি মনে করেন? নিচে কমেন্টে শেয়ার করুন।